আমাদের গাড়ি যখন ভৈরব আশুগঞ্জের সংযোগস্থল মেঘনা নদীর উপর নির্মিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু পার হচ্ছিল ঘড়ির কাটা তখন পাঁচটা ত্রিশ মিনিট ছুঁয়েছে। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী সুর বেজেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- “ আর নাইরে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে”। ঠিক সন্ধ্যা লগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক মহান সংগঠকের নামে নামকরণকৃত সেতুটির উপর দিয়ে আশুগঞ্জ পাওয়ারপ্লান্টের রেস্টহাউজের ১১১ নম্বর রুমে গিয়ে উঠলাম। মেঘনার তীর ঘেঁষে অবস্থিত এই রেস্টহাউজটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে থাকার দারুণ সু-ব্যবস্থা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিঙ্গেল, ডাবল ও ভিআইপি রুমগুলো সত্যিই আরামদায়ক। এখানকার পরিবেশও বেশ চমত্কার। রয়েছে মিনি পার্ক, ফুলের বাগান, নানা প্রজাতির গাছ। বলতে গেলে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকারও নেই কোনো কারণ। সুবিশাল ডাইনিং ও টিভিরুমটিও বেশ গোছালো। যদিও খাবারের মান নিয়ে রয়েছে অনেকের আপত্তি। তথাপি নিঃসন্দেহে এটিকে অবকাশ যাপনের উপযোগী স্থান বালা বাঞ্ছনীয়।
পাওয়ারপ্লান্টের নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাকারীরা সাধুবাদ পেতে পারেন, সঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য। এ রেস্টহাউজটিতে থাকার অন্য সুবিধা হচ্ছে প্রতিটি কামরায় বসে দৃষ্টি প্রসারিত করলে মেঘনার সব রূপ-বৈচিত্র্য, সংগ্রামী মানুষের জীবন-জীবিকা, গন্তব্যে ছুটে চলার উপায়-অবলম্বন দেখা ও বোঝা যায়। কত বিচিত্র পেশার মানুষ বেঁচে আছেন এই নদীটি নির্ভর করে। কত মানুষ স্বপ্ন বোনে এই নদীকে অবলম্বন করে। আবার কত স্বপ্ন-ভবিষ্যত্ বিলীন হয়ে যায় এর ভাঙনে। তবুও মেঘনা জীবন চলার সাথী, বেঁচে থাকার প্রেরণা। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের উপযোগী বন্ধু। তবে প্রমত্তা মেঘনা এখন একেবারে শান্ত। রেস্ট হাউজের কোল ঘেঁষে বিস্তৃত বালুচরে চোখ রাখলে মনেই হবে না এ নদী রূপ একদা কত ভয়ঙ্কর ছিল। নদীও এখন নিষ্ঠুর রাজনীতির শিকার। নদী মরে গেলে, নাব্যতা হারালে কাদের লাভ?
রাত যত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে নদীর নীরবতাও; যদিও মাঝে মাঝে এ নীরবতায় ছেদ পড়ে জেলেদের মাছ ধরার ব্যাকুল আয়োজনে। চর জাগার কারণে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে এর গতিপথও। যা সহজেই অনুমেয়। তথাপি নদীর জীবন আমাদের কত আপন। নদীর জীবনের সাথে মিশে আছে আমাদেরও জীবন। এ উপলদ্ধি দাদা-দিদিদের কোথায়? নদীর পানি নিয়ে নষ্ট রাজনীতির অবসান তাই মানবিক কারণেই জরুরি।
রাতে রেস্ট হাউজের চারদিকে নিয়নবাতির আলোরছটা থাকলেও অদূরে নদীতে নিঃসিম অন্ধকার। বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-সেদিক অন্ধকার ভেদ করে কিছু বাতি মিট মিট করে জ্বলে জেলেদের নৌকায় আর জলযানে। তখন অবশ্য টের পাওয়া যায় এ অন্ধকারের উপরে আছে জীবনের কোলাহল। এমন দৃশ্য দেখতে অবশ্য ভালই লাগে। রাতের নীরবতা ও অন্ধকার ছুঁয়ে আসা হিমেল হাওয়া যে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়, তাতে মন এক অনাবিল প্রশান্তিতে নেচে উঠে। কীযে ভাললাগে তখন! গত ৩০ অক্টোবর রাতটি ছিল সত্যিই এক আনন্দ-উত্ফুল্লময় রাত। ভাল লাগার রাত। নদীর কাছাকাছি থাকার রাত। অভিসারের রাত। স্মৃতির ঘাটে বারবার ফিরে যাবার রাত। আবাল্যের বন্ধু খোকা আর আমার নিদ্রাহীন গল্পে গল্পে সময় কাটানোর রাত। রাতের মেঘনাকে পর্যবেক্ষণের রাত।
অনুকূল প্রতিবেশ-পরিবেশ মানুষকে যে কত প্রাণিত করতে পারে তা এখানে রাত না কাটালে হয়তো বুঝতেই পারতাম না। কত কিছু যে জানা-বোঝা-উপলদ্ধি করা যায়, যায় শেখা তা বলে বোঝানো যাবে না। এরকম একটি রাতের গুরুত্ব জীবনে যে কী অসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা আগে বুঝিনি বলে ফিরে ফিরে ঐ রাতটির কথাই মনে ভাসছে।
মেঘনার তীরে বৃহত্ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার কারণে (যেমন- পাওয়ারপ্লান্ট, সার কারখানা) এখানে যেমন ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক কারণে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আগ্রহ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। গড়ে উঠেছে নামি-দামি হোটেল-মোটেল, রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট। আর.জে টাওয়ার, উযান-ভাটি, প্রভৃতি এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আশুগঞ্জ ও ভৈরবে কতযে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, অত্যাধুনিক বাড়ি চোখে পড়ল যা দেখে অবাক লেগেছে। মেঘনার দু’তীরে গড়ে উঠা এতসব অট্টালিকা মনে করিয়ে দেয় এখানকার শিল্প ও ভ্রমণ উপযোগী পরিবেশ ও এর গুরুত্ব। আর সবেচেয়ে বড় কথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুটি চালু হওয়ার পর ভৈরব এবং আশুগঞ্জের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এর রূপই পাল্টে গেছে। একটি সেতু যে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, এটি তার নিদর্শন। যাতায়াতের অবাধ সুযোগ এবং সময়ের স্বল্পতা দু’তীরের মানুষকে যেমন ঘনিষ্ঠ করেছে, করেছে কর্মচঞ্চল, তেমনি ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত সম্প্রসারণ। বেড়েছে এর ব্যাপক পরিচিতি এবং সুযোগ-সুবিধাও। ঢাকা-সিলেট যাওয়ার পথে এখন যাত্রা বিরতীর উত্তম স্থান এই জায়গা।
এক রাত এবং দিনের শেষে ফিরতি পথে ইছাকাঠিতে নানা প্রজাতির যে সবজি বাগান চোখে পড়ল, তা দেখে নিজেকে স্থির রাখা কঠিন। মনে হয়েছে গাড়ি থেকে নেমে এর মাঝে গিয়ে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসি। বন্ধু মোজাফ্ফরকে সে কথা বলতে বলতে আমাদের গাড়ি চলছি বাড়ি.......